শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
 

১০ দিন ধরে চিকিৎসা সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না গাজায়     তাপপ্রবাহ কমে আসতে পারে বৃষ্টি    রাঙামাটিতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ইউপিডিএফ কর্মীসহ নিহত ২     টেক্সাসে ঝড়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ জনে    ৪ বিভাগে আবারো তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা    পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফার গল্প’ বাদ দেয়ার সুপারিশ    র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করছে না যুক্তরাষ্ট্র   
বিদ্রোহী কবিতার আলাকে কবি নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার স্বরূপ বিশ্লেষণ
প্রকাশ: সোমবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২২, ৮:০৬ অপরাহ্ন

কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে রচিত এই কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক। একশো বছর পরেও সেই কবিতার আবেদন ফুরায়নি, রয়ে গেছে আগের মতোই। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন প্রায় দেড়শ পঙক্তির এই ভুবনবিজয়ী কবিতা।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি ও সর্বমানবিক মুক্তির প্রবক্তা কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কবিতা বিদ্রোহী। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এই কবিতাটি রচিত হয়েছিল। সমূলক হােক আর অমূলক হােক, বিদ্রোহের কোনাে স্বীকৃত ব্যাকরণ নেই। বিদ্রোহ স্বতঃস্ফুর্ত স্বতােৎসারিত, সর্বগ্রাসী ও সংক্রামক।

বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। ভারতীয় এবং পশ্চিম এশীয় পুরাণ ও ইতিহাসের আধার থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নজরুল এখানে প্রবল বিদ্রোহ বাণী উচ্চারণ করেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, শৃঙ্খলপরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। এই কবিতা রচনার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবির আখ্যা পেয়েছেন। এখানে নজরুল তার বিদ্রোহকে সঙ্গত কারণেই ‘আমি’ প্রতীকে ব্যঞ্জনাময় করেছেন এবং নিজেকে অজেয় বলে উপলব্ধি করেছেন। তাইতাে’ বিদ্রোহী আত্মশক্তিকে উদ্বোধিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কবির সরব ঘােষণা: ‘বল বীর বল উন্নত মম শির! নজরুল এই কবিতার প্রথম স্তবকেই প্রসঙ্গত উত্থাপন করেছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা, ভূলােক দ্যুলােক, খােদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা।

বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মােট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তবকে আমি’-র শক্তিমত্তার পাশাপাশি রয়েছে বিজয়ের প্রত্যয় , আর এই বিজয়ের জন্য প্রয়ােজন আঘাতকারীর। আমি’-র ধ্বংসাত্মক রূপ, যা কবিতাটির ১১ থেকে ২৭ পঙক্তি পর্যন্ত ঘূর্ণিত: ‘আমি ঝঞা, আমি ঘূর্ণি। আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি। শক্তির উদ্বোধন ও সংহারচিত্রের পরই হঠাৎ শুরু হলাে মিলনের নৃত্যপাগল ছন্দ। ২৮ থেকে ৩৭ পঙক্তি পর্যন্ত আমি এমন এক মুক্ত জীবনান্দ, যে শত্রুর সাথে গলাগলি করে, আবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। কিন্তু মিলনের এই আকাঙ্ক্ষার পর পরবর্তী দুই পঙক্তিতে ‘আমি’ আবার মহামারী, ভীত, শাসন-ত্রাসন ও সংহার রূপে আবির্ভূত। তারপর ৪২ থেকে ৫১ সংখ্যক পঙক্তিতে আবার আছে উদ্দাম ইতিবাচকতা, হােমশিখা, উপাসনা, নিশাবসানের আকাঙ্ক্ষা। আর এই অংশের ৪৯ তম পঙক্তিতেই আছে সেই জাদুকরী সরল স্বীকারােক্তি:মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য।

এই কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরানিক রুপকের ব্যবহার এতােটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রূপকের প্রয়ােগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতােটা দখল ছিল। এই কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে তা ধাপে ধাপে নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলাে: ভূলােক মানে পৃথিবী, দ্যুলােক মানে স্বর্গ, আর গােলক মানে বিষ্ণুলােক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান। কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত। ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতাে ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্রাতার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন।

গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়। পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যানার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু। চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গােত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গােত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গােত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মােঙ্গল গােত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন। ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন।

সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী সত্তা কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিচিত্তে বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ঘুমন্ত দেশ ও জাতিকে মুক্ত করবার জন্য নিজে যেমন বিদ্রোহ ঘােষণা করেছেন, তেমনি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। কবি জরাজীর্ণ পুরাতন সমাজ ও রীতিনীতি ভেঙ্গে নতুন দেশ ও জাতি গড়তে তার কাব্যে ভাঙনের খেলা খেলেছেন। কবি পরাধীনতার বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছেন। সমকালীন যুগ, তার রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত সংশয়, দ্বিধা, অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় সুকান্তর কবিসত্তা গড়ে তুলেছে। তার কবিতায় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবিতায়ও দেখা যায় – সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা পদদলিত এদেশ দীর্ঘকাল শাসন, শােষণ, অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্যের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন থেকেছে। সমাজ সচেতন কবি এ সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবিতায় কবির এই বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ উচ্চকিত থাকবে যতদিন না তার মূল উৎপাটিত হয়।

বর্তমান সময়ে নানা রকম অসাম্যের ভীড়ে আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি ‘ বিদ্রোহী’ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ও তার অম্লান তাৎপর্যের কথা। উপনিবেশবাদের অবসান ঘটলেও বিশ্বায়নের শৃঙ্খল আর ধনতন্ত্রের শােষণ বঞ্চনা অত্যাচার নির্যাতনসহ আর্থসামাজিক বৈষম্য সবকিছুই বলবৎ আছে। অত্যাচারীর থঙ্গ কৃপাণে’র তলে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল’ এই বাংলার আকাশে -বাতাসে আজও প্রতিনিয়ত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। অন্যদিকে মানুষের শক্তির প্রতি, তার বীরত্বের প্রতি অনাস্থাও সমানভাবে অটুট। তাই নজরুলের ভাষায়- শান্ত থাকার অবকাশ মিলছে চতুষ্পর্শের প্রতিবাদহীন মেরুদণ্ডহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল কাম্য হয়ে উঠেছে উন্নত মম শির’- এর বজ্ৰদীপ্ত ঘােষণা। শােষণ পীড়ন আর বৈষম্য থেকে মুক্তির সংকল্প নিয়ে মানুষের আপন শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে নজরুল কথিত বিদ্রোহের রণে অশ্লীন হওয়ার যেন বিকল্প নেই। চোখে স্বদেশে ও স্বকালে নজরুলের বিদ্রোহীর মূর্তিমান প্রতিকৃতির নাম ৭ই মার্চের ভাষণদানরত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, যিনি উর্ধলােকে তর্জনী উঁচিয়ে সামষ্টিক বাঙালির স্বাধীনতা ঘােষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি মানুষের প্রান্তমুক্ত বিদ্রোহী সত্তার বাস্তব অভিব্যক্তিকেই মূর্ত করে তুলেছেন। ব্যক্তি বাঙালি আর সর্বকালের সর্বপ্রান্তের ব্যক্তি মানুষের শক্তি মত্তার এই জয়গান মূলত প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক প্রতিকূলতা জয়ী মানবিক শক্তিরই অনিবার্য স্বীকৃতি। সভ্যতার ইতিবাচক অগ্রগমণের প্রয়ােজনে যুগে যুগে এই মূর্ত প্রতীক বার বার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে আবির্ভূত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিদ্রোহী’র এই মঙ্গলশক্তির জয় হােক।

পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতাে। ধূমকেতুর মতােই তিনি যুদ্ধ ঘােষণা করেছেন দাসত্বের বিরুদ্ধে, শােষণে শােষণে জর্জরিত জীর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তার এই বিদ্রোহ সমাজের সর্বস্তরে ধেয়ে চলেছে। সর্বোপরি, কবির বিদ্রোহ চেতনায় প্রবল অহমিকা প্রকাশিত হয়েছে।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft